রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আতঙ্কের নাম ছাত্রলীগ
আনু মোস্তফা ও আসাদুর রহমান
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের নৃশংস হামলায় ছাত্রলীগকর্মী ফারুক নিহত ও অর্ধশত ছাত্র আহত হওয়ার ঘটনার জের ধরে প্রায় এক যুগ পর শিবিরের রাহুমুক্ত ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মুক্ত পরিবেশের প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তাঁদের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী ক্যাডাররা। গত সাত মাসে ক্যাম্পাসে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রলীগ এখন একটি আতঙ্কের নাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল আক্ষেপ করে বলেন, ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সংগঠনের নামে বাতি জ্বালানোর জন্য ছাত্রলীগের কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতার আসার পর কোথা থেকে এত ক্যাডার সংগঠনে ঢুকে পড়ল কেউ বলতে পারে না। এরাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির শবদেহে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে ১৫ আগস্ট।
এই দিন নিজের দলের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে এসএম হলের ছাদ থেকে পৈশাচিক কায়দায় নিচে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ নামধারী ক্যাডাররা। ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নাসিমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শবযাত্রা শুরু হলো_মন্তব্য করেন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রবীণ শিক্ষক। তিনি বলেন, 'এখন কী আর করা, আবার শিবিরের রাজ্যে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা!'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৭ জানুয়ারি ৯ বছরের পুরনো কমিটি বিলুপ্ত করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি করা হয় নামকাওয়াস্তে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে। এই কমিটি ঘোষণার আগে কোনো নেতা-কর্মীর মতামত নেওয়া হয়নি। পাবনা গ্রুপের আওয়াল কবির জয়কে সভাপতি ও রাজশাহী গ্রুপের মাজেদুল ইসলাম অপুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। রেজওয়ান আহমেদ শুভ্রকে সহসভাপতি, ফুয়াদ হোসেন মুরাদ ও আবু হোসেন বিপুকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইলাকে করা হয় সাংগঠনিক সম্পাদক। কমিটি গঠনের দিন থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে গ্রুপিং শুরু হয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ মার্চ পরীক্ষা চলার সময় হলে প্রবেশ করে শিবির খোঁজার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সভাপতি জয়ের নেতৃত্বে একদল ক্যাডার বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদিসহ অন্য শিক্ষকদের গালাগাল দেওয়া ছাড়াও তাঁদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। গত ১ এপ্রিল জয় গ্রুপের ছাত্রলীগকর্মী কাউসার তাপসী রাবেয়া হলের সামনে প্রেমের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় প্রকাশ্যে এক ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনার পর কাউসার ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাউসারের ছাত্রত্ব বাতিল করে।
গত ৬ এপ্রিল রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের শিবির নিয়ন্ত্রিত সিলগালা করা একটি কক্ষ খোলার সময় বাধা দিলে সভাপতি জয়ের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হল প্রাধ্যক্ষ ড. মোর্তাজা খালেদকে তাঁর কক্ষে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। প্রক্টরের উপস্থিতিতেই ক্যাডাররা প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে ও হল অফিসের তিনটি কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
মোটা অঙ্কের চাঁদা না পেয়ে গত ১৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান হল থেকে তুলে এনে অনুশীলন নাট্যদলের কর্মী মামুনুর রশীদ জনিসহ তিনজনকে সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে সিগারেটের আগুনে শরীরে ছেঁকা দেওয়া হয়। কক্ষটি তালাবদ্ধ করে তাঁদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে নির্যাতন করা হয় ছাত্রলীগকর্মী মাসুদ পারভেজের নেতৃত্বে। পরে সাধারণ ছাত্ররা জনিসহ তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। এই ঘটনায় মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে মামলা হলেও পুলিশ কখনো তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেনি। জানা যায়, মাসুদ পারভেজ একসময় ছাত্রদল করত। পরে সভাপতি জয়ের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগে ঢুকে পড়ে সে।
এসএম হলের ছাত্ররা জানান, গত ৯ জুন সভাপতি জয় গ্রুপের ক্যাডার ফেরদৌস প্রতিপক্ষ অপু গ্রুপের কর্মী মিঠুন হালদারের একটি নতুন সাইকেল চুরি করে। হল প্রশাসন তদন্ত করে নিশ্চিত হয় ফেরদৌসই এ কাজ করেছে। কর্তৃপক্ষ ফেরদৌসকে কক্ষ থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ফেরদৌস দলবলসহ মিঠুনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তাঁকে গুরুতর আহত করে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের ক্যাডারদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৫ বার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। মতিহার থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, এই কয় মাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে উভয় পক্ষে থানায় এক ডজন মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্তকাজও চলছে।
জানা যায়, সর্বশেষ গত ৮ আগস্ট জয় ও অপু গ্রুপের ক্যাডারদের সশস্ত্র সংঘর্ষে ক্যাস্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে গোলাগুলি চলে পুলিশের সামনেই। উভয় গ্রুপের ২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। উভয় গ্রুপের পক্ষে মতিহার থানায় মামলা হয়। পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আসামি করা হয়। এই দিন সন্ধ্যার পর পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সাধারণ সম্পাদক অপুকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে সে জেলহাজতে। এই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। ১৫ আগস্ট জয় গ্রুপের ১০-১২ জন ক্যাডার ছাত্রলীগকর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নির্যাতনের পর এসএম হলের ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হয়নি।
শিবিরমুক্ত সাত মাসের ক্যাম্পাসে সভাপতি জয় শিবির ধরার নাম করে হলে ও হলের বাইরে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ছাত্রলীগ নেতা ওয়ালিদ আহমেদ কমল বলেন, কতিপয় ছাত্রলীগ ক্যাডার শিবির ধরার নামে অনেক ছাত্রকে ধরেছেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করে ছেড়েও দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিবিরের ক্যাডাররা সংশ্লিষ্ট হলের ছাত্রলীগের প্রভাবশালী ক্যাডারদের সঙ্গে গোপনে যোগোযোগ করে টাকা-পয়সা দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অত্যাচারে হলের সাধারণ ছাত্ররাও অতিষ্ঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি ছাত্র হল থেকে গত ছয় মাসে সাড়ে তিন শতাধিক আবাসিক ছাত্র ক্যাম্পাসের বাইরে মেসে বা বাসাবাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। আবাসিকতা বাতিল করা এসএম হলের ছাত্র শহীদুল বলেন, ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে কেউ কেউ এমন বাড়াবাড়ি করছে যে আর হলে থাকাই গেল না।
সূত্রে আরো জানা গেছে, গত সাত মাসে শামসুজ্জোহা, এসএম সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু হলের বিভিন্ন কক্ষের সিলগালা করা কক্ষগুলো থেকে শতাধিক কম্পিউটার লুট করেছে কতিপয় ছাত্রলীগ ক্যাডার। এসব কক্ষ শিবির দখলে নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছিল। ৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর এসব কক্ষে থাকা ছাত্ররাও পালিয়ে যান। পরে ফিরে এসে কম্পিউটারসহ রেখে যাওয়া জিনিসপত্র পাননি তাঁরা। এ প্রসঙ্গে ফলিত রসায়নের চুতর্থ বর্ষের ছাত্র সানি জানান, তিনি কোনো রাজনীতি করেন না। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হলে শিবিরের দখল করা একটি রুমে মাসিক ৬০০ টাকা ভাড়ায় থাকতেন। ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হল ছেড়ে যান তিনি। রুমে কম্পিউটারও ছিল। ৮ ফেব্রুয়ারির পরপরই সেটি ছাত্রলীগের কয়েকজন ক্যাডার রুম খুলে নিয়ে যায় বলে হল কর্মচারীদের কাছ থেকে জানা গেছে। তাই এখন হল ছেড়ে তিনি মেসে উঠেছেন।
আরবি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান সজল বলেন, গত ২০ জুলাই ছাত্রলীগকর্মী সবুজ সারওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে হলে তাকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে বলে জানায়।' তিনি বলেন, ২৩ জুলাই সবুজ মেসে গিয়ে চাঁদা নেওয়ার জন্য তাঁকে ভয়-ভীতি দেখায়। চাঁদা না দিয়ে ক্যাম্পাসে গেলে শিবির পরিচয়ে তাঁকে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। গত কাউন্সিলের সময় সবুজ সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, 'এদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করছে। কে কোন বিভাগে পড়ে, বাড়ি-ঘরের ঠিকানা, আগে কী করত, ক্যাম্পাসে কে কখন কী ধরনের বিশৃঙ্খলা করেছে তার সব বিবরণই আমরা সংগ্রহ করছি।' ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, এভাবে একটি ছাত্র সংগঠন চলতে পারে না। এত বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৬ জুন মাদার বখশ হলে জয়-অপু গ্রুপের ক্যাডারদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ ক্যাডার শাহনেওয়াজ টোকন, রুহুল আমিন বাবু, ফারুখ হোসেন, আলিম ও আনোয়ারকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ১৭ জুন সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন মুন, জয়, অপুসহ ছাত্রলীগ নেতারা থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এভাবে আটকের পর থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে মতিহার থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, 'নেতারা এসে বললেন, তারা আর কোনো ঝামেলা করবে না। তা ছাড়া আমরা নিজেরাই মীমাংসা করে ফেলেছি। তাই ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়।'
বক্তব্য নিতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আওয়াল কবির জয় বলেন, 'একটু পরে কথা বলছি।' পরে তিনি তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম সোবহান বলেন, 'কাম্পাসে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমরা চেষ্টা করেছি। কাউসার নামের এক ছাত্রলীগকর্মী একটি মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল, আমরা তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছি।' চরম বিশৃঙ্খলা করেছে এমন ছাত্রদের তালিকা করে তাদের ব্যাপারেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কর্তৃপক্ষ ভাবছে বলে তিনি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল আক্ষেপ করে বলেন, ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সংগঠনের নামে বাতি জ্বালানোর জন্য ছাত্রলীগের কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতার আসার পর কোথা থেকে এত ক্যাডার সংগঠনে ঢুকে পড়ল কেউ বলতে পারে না। এরাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির শবদেহে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে ১৫ আগস্ট।
এই দিন নিজের দলের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে এসএম হলের ছাদ থেকে পৈশাচিক কায়দায় নিচে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ নামধারী ক্যাডাররা। ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নাসিমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শবযাত্রা শুরু হলো_মন্তব্য করেন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রবীণ শিক্ষক। তিনি বলেন, 'এখন কী আর করা, আবার শিবিরের রাজ্যে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা!'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৭ জানুয়ারি ৯ বছরের পুরনো কমিটি বিলুপ্ত করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি করা হয় নামকাওয়াস্তে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে। এই কমিটি ঘোষণার আগে কোনো নেতা-কর্মীর মতামত নেওয়া হয়নি। পাবনা গ্রুপের আওয়াল কবির জয়কে সভাপতি ও রাজশাহী গ্রুপের মাজেদুল ইসলাম অপুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। রেজওয়ান আহমেদ শুভ্রকে সহসভাপতি, ফুয়াদ হোসেন মুরাদ ও আবু হোসেন বিপুকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইলাকে করা হয় সাংগঠনিক সম্পাদক। কমিটি গঠনের দিন থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে গ্রুপিং শুরু হয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ মার্চ পরীক্ষা চলার সময় হলে প্রবেশ করে শিবির খোঁজার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সভাপতি জয়ের নেতৃত্বে একদল ক্যাডার বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদিসহ অন্য শিক্ষকদের গালাগাল দেওয়া ছাড়াও তাঁদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। গত ১ এপ্রিল জয় গ্রুপের ছাত্রলীগকর্মী কাউসার তাপসী রাবেয়া হলের সামনে প্রেমের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় প্রকাশ্যে এক ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনার পর কাউসার ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাউসারের ছাত্রত্ব বাতিল করে।
গত ৬ এপ্রিল রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের শিবির নিয়ন্ত্রিত সিলগালা করা একটি কক্ষ খোলার সময় বাধা দিলে সভাপতি জয়ের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হল প্রাধ্যক্ষ ড. মোর্তাজা খালেদকে তাঁর কক্ষে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। প্রক্টরের উপস্থিতিতেই ক্যাডাররা প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে ও হল অফিসের তিনটি কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
মোটা অঙ্কের চাঁদা না পেয়ে গত ১৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান হল থেকে তুলে এনে অনুশীলন নাট্যদলের কর্মী মামুনুর রশীদ জনিসহ তিনজনকে সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে সিগারেটের আগুনে শরীরে ছেঁকা দেওয়া হয়। কক্ষটি তালাবদ্ধ করে তাঁদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে নির্যাতন করা হয় ছাত্রলীগকর্মী মাসুদ পারভেজের নেতৃত্বে। পরে সাধারণ ছাত্ররা জনিসহ তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। এই ঘটনায় মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে মামলা হলেও পুলিশ কখনো তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেনি। জানা যায়, মাসুদ পারভেজ একসময় ছাত্রদল করত। পরে সভাপতি জয়ের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্রলীগে ঢুকে পড়ে সে।
এসএম হলের ছাত্ররা জানান, গত ৯ জুন সভাপতি জয় গ্রুপের ক্যাডার ফেরদৌস প্রতিপক্ষ অপু গ্রুপের কর্মী মিঠুন হালদারের একটি নতুন সাইকেল চুরি করে। হল প্রশাসন তদন্ত করে নিশ্চিত হয় ফেরদৌসই এ কাজ করেছে। কর্তৃপক্ষ ফেরদৌসকে কক্ষ থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ফেরদৌস দলবলসহ মিঠুনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তাঁকে গুরুতর আহত করে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের ক্যাডারদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৫ বার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। মতিহার থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, এই কয় মাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে উভয় পক্ষে থানায় এক ডজন মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্তকাজও চলছে।
জানা যায়, সর্বশেষ গত ৮ আগস্ট জয় ও অপু গ্রুপের ক্যাডারদের সশস্ত্র সংঘর্ষে ক্যাস্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে গোলাগুলি চলে পুলিশের সামনেই। উভয় গ্রুপের ২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। উভয় গ্রুপের পক্ষে মতিহার থানায় মামলা হয়। পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আসামি করা হয়। এই দিন সন্ধ্যার পর পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সাধারণ সম্পাদক অপুকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে সে জেলহাজতে। এই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। ১৫ আগস্ট জয় গ্রুপের ১০-১২ জন ক্যাডার ছাত্রলীগকর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নির্যাতনের পর এসএম হলের ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হয়নি।
শিবিরমুক্ত সাত মাসের ক্যাম্পাসে সভাপতি জয় শিবির ধরার নাম করে হলে ও হলের বাইরে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ছাত্রলীগ নেতা ওয়ালিদ আহমেদ কমল বলেন, কতিপয় ছাত্রলীগ ক্যাডার শিবির ধরার নামে অনেক ছাত্রকে ধরেছেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করে ছেড়েও দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিবিরের ক্যাডাররা সংশ্লিষ্ট হলের ছাত্রলীগের প্রভাবশালী ক্যাডারদের সঙ্গে গোপনে যোগোযোগ করে টাকা-পয়সা দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অত্যাচারে হলের সাধারণ ছাত্ররাও অতিষ্ঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি ছাত্র হল থেকে গত ছয় মাসে সাড়ে তিন শতাধিক আবাসিক ছাত্র ক্যাম্পাসের বাইরে মেসে বা বাসাবাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। আবাসিকতা বাতিল করা এসএম হলের ছাত্র শহীদুল বলেন, ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে কেউ কেউ এমন বাড়াবাড়ি করছে যে আর হলে থাকাই গেল না।
সূত্রে আরো জানা গেছে, গত সাত মাসে শামসুজ্জোহা, এসএম সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু হলের বিভিন্ন কক্ষের সিলগালা করা কক্ষগুলো থেকে শতাধিক কম্পিউটার লুট করেছে কতিপয় ছাত্রলীগ ক্যাডার। এসব কক্ষ শিবির দখলে নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছিল। ৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর এসব কক্ষে থাকা ছাত্ররাও পালিয়ে যান। পরে ফিরে এসে কম্পিউটারসহ রেখে যাওয়া জিনিসপত্র পাননি তাঁরা। এ প্রসঙ্গে ফলিত রসায়নের চুতর্থ বর্ষের ছাত্র সানি জানান, তিনি কোনো রাজনীতি করেন না। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হলে শিবিরের দখল করা একটি রুমে মাসিক ৬০০ টাকা ভাড়ায় থাকতেন। ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হল ছেড়ে যান তিনি। রুমে কম্পিউটারও ছিল। ৮ ফেব্রুয়ারির পরপরই সেটি ছাত্রলীগের কয়েকজন ক্যাডার রুম খুলে নিয়ে যায় বলে হল কর্মচারীদের কাছ থেকে জানা গেছে। তাই এখন হল ছেড়ে তিনি মেসে উঠেছেন।
আরবি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান সজল বলেন, গত ২০ জুলাই ছাত্রলীগকর্মী সবুজ সারওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে হলে তাকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে বলে জানায়।' তিনি বলেন, ২৩ জুলাই সবুজ মেসে গিয়ে চাঁদা নেওয়ার জন্য তাঁকে ভয়-ভীতি দেখায়। চাঁদা না দিয়ে ক্যাম্পাসে গেলে শিবির পরিচয়ে তাঁকে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। গত কাউন্সিলের সময় সবুজ সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, 'এদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করছে। কে কোন বিভাগে পড়ে, বাড়ি-ঘরের ঠিকানা, আগে কী করত, ক্যাম্পাসে কে কখন কী ধরনের বিশৃঙ্খলা করেছে তার সব বিবরণই আমরা সংগ্রহ করছি।' ক্যাম্পাসে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, এভাবে একটি ছাত্র সংগঠন চলতে পারে না। এত বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৬ জুন মাদার বখশ হলে জয়-অপু গ্রুপের ক্যাডারদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ ক্যাডার শাহনেওয়াজ টোকন, রুহুল আমিন বাবু, ফারুখ হোসেন, আলিম ও আনোয়ারকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ১৭ জুন সাবেক সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন মুন, জয়, অপুসহ ছাত্রলীগ নেতারা থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এভাবে আটকের পর থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে মতিহার থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, 'নেতারা এসে বললেন, তারা আর কোনো ঝামেলা করবে না। তা ছাড়া আমরা নিজেরাই মীমাংসা করে ফেলেছি। তাই ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়।'
বক্তব্য নিতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আওয়াল কবির জয় বলেন, 'একটু পরে কথা বলছি।' পরে তিনি তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম সোবহান বলেন, 'কাম্পাসে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমরা চেষ্টা করেছি। কাউসার নামের এক ছাত্রলীগকর্মী একটি মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল, আমরা তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছি।' চরম বিশৃঙ্খলা করেছে এমন ছাত্রদের তালিকা করে তাদের ব্যাপারেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কর্তৃপক্ষ ভাবছে বলে তিনি জানান।
Shudhu Atonker Name Naa, Jolatonker Name O Satro League.
ReplyDeleteKaron Kuttar Kamorei Jolatonko Hoy. R Satro League Holo Khepa Kutta....